অক্টোবরের হামাসের হামলা ইসরায়েলি সমাজের জন্য একটি কঠিন ধাক্কা ছিল। তা ছিল সমন্বিত, কেন্দ্রীভূত, মারাত্মক এবং নৃশংস। ইসরাইলের অতি গর্বের প্রতিরক্ষা, গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলি – অজান্তেই অপ্রস্তুত ও অপমান জনক অবস্থায় পড়ে গিয়েছিল।
তাদের প্রথম রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতেই লেগে যায় কয়েক দিন। সপ্তাহের উপরে লেগে যায় প্রথম গন জমায়েত করতেই। তিন সপ্তাহ পর্যন্ত ক্রমাগত নির্বিচার বোমাবর্ষণ ও গুলি চালনার মধ্যে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজা অতিক্রম করে। তারপর, দুই মাসেরও বেশি স্থল যুদ্ধে, সেনাবাহিনী গাজা শহরকে অবরুদ্ধ করে ফেলে।
ঘটনা শুরু হওয়ার প্রায় তিন মাসের মাথায় এসে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডইএফ) দাবি করেছে যে তারা সাড়ে আট হাজারের অধিক হামাস যোদ্ধাকে হত্যা করেছে। যদি এই পরিসংখ্যান সঠিক হয় তাহলে আইডিএফ কর্তৃক নিহত মোট একুশ হাজার আটশোর মধ্যে অসামরিক জনসাধারণের সংখ্যা তেরো হাজারের বেশি। কিন্তু বাস্তবে তাদের পরিসংখ্যান কতটুকু বিশ্বাস যোগ্য? স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র মতে হামাস যোদ্ধাদের মৃতের সংখ্যা চার হাজারের মতো। এক্ষেত্রে আইডিএফ কর্তৃক নিহত অসামরিক জনসাধারণের সংখ্যা সতের হাজারের অধিক। তার মধ্যে শিশু রয়েছে সাড়ে আট হাজারের ওপরে। এই সংখ্যাটি অগ্রহণযোগ্য হিসাবে বিবেচিত হয়, যে কোনও পরিস্থিতিতে। বিশ্বজুড়ে অনেক লোক যারা বিশ্বাস করে যে যখনই এবং যাই হোক যুদ্ধ শেষ হবে। তখন সেই মৃত অসামরিক লোকেরা পুরো ইস্রায়েলকে তাড়া করতে ফিরে আসবে।
অপর দিকে ইসরাইলের দাবিকৃত এখনো পর্যন্ত নিহত ১৭২ জন ইসরায়েলি সৈন্যের মধ্যে, সিনিয়র নন-কমিশনড অফিসারদের অনুপাত অস্বাভাবিক ভাবে বেশি। কিন্তু যুদ্ধে মারা যাওয়া অফিসারদের সংখ্যা বিস্ময়কর, মৃতদের মধ্যে চারজন পূর্ণ কর্নেলের কম নয়।
আইডিএফ এর লক্ষ্য ছিল হামাসকে ধ্বংস করার পাশাপাশি, গাজায় ইসরায়েলি অনুপ্রবেশের অন্য প্রধান ঘোষিত লক্ষ্য ছিল অবশিষ্ট বন্দীদের মুক্ত করা। শুধু এই লক্ষ্য অর্জনেই তারা ব্যর্থ হয়নি, বরং ইসরায়েল হামাসের তিন বন্দিকে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছে যারা আত্মত্যাগ করার চেষ্টা করেছিল।
হামাসকে “সন্ত্রাসী” বলা পশ্চিমা বিশ্বেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধরা পড়েছে – পৃথিবীর বাকি অংশের জন্য ততটা গ্রহনযোগ্য মনে হয়নি। বিশেষ করে হামাসকে আইএসআইএল (আইএসআইএস) এর সাথে সমতুল্য করার প্রচেষ্টা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ছিল বিশ্বকে এই দাবি বিশ্বাস করানো যে “ইসরায়েল বেসামরিক ক্ষতি কমাতে এবং আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ”। এমনকি ইসরায়েলিরাও এই দাবি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা অবশ্যই তার ইচ্ছাকৃত, অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং নৃশংস অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া হতে পারে – যা হাজার হাজার বেসামরিক মানুষকে হত্যা করেছে।
৭ অক্টোবর থেকে গাজায় নিহত ফিলিস্তিনিদের মোট সংখ্যা ১ জানুয়ারি পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে ২২১৮৫, এবং কমপক্ষে ৫৭,০০০ আহত হয়েছে, হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ তথ্য ঘোষণা করেছে।
মধ্যপ্রাচ্য কাউন্সিল অন গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্সের একজন সিনিয়র ফেলো আদেল আবদেল গাফর বলেছেন “হত্যাকাণ্ড, বাস্তুচ্যুত জনসংখ্যা, মৃত শিশু এবং অনাহারের দৃশ্য আমাদের পর্দায় পূর্ণ করার কারণে, জোয়ার সত্যিই সরে যাচ্ছে,”। তিনি যোগ করেছেন যে ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে বিশাল প্যালেস্টাইনপন্থী সমাবেশগুলি রাজনীতিবিদ দের উপর চাপ সৃষ্টি করেছে, বেলজিয়ামের মতো কিছু ইউরোপীয় দেশ গাজা নিয়ে তাদের সুর পরিবর্তন করেছে এবং যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে, যা ইসরাইল দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর প্রকাশিত সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে, ৭ অক্টোবর গাজা সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে ৫০৭ সেনা নিহত এবং ২২৬৫ জন আহত হয়েছে।
গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে তরুণরা সারা বিশ্বে বিক্ষোভ চালাচ্ছে।গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী বিক্ষোভ কয়েক মাস ধরে চলা হামলার বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষোভকে প্রতিফলিত করে। তরুণরা প্রতিবাদের অগ্রভাগে থাকছে।
গাজায় ‘গণহত্যার অপরাধে’ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) মামলা দায়ের করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। গাজায় প্রায় তিন মাস ধরে অব্যাহতভাবে চালানো ধ্বংসযজ্ঞ ও বোমা হামলায় ২১ হাজার ৫০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হওয়ার পর এমন অভিযোগে মামলা করল দেশটি। তবে জাতিসংঘের আদালতে মামলাটি প্রত্যাখ্যান করেছে ইসরায়েল। যদিও দেশটিকে ফিলিস্তিনিদের ওপর সম্মিলিত শাস্তির অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক বিচার আদালত, যেটিকে বিশ্ব আদালতও বলা হয়। এটি একটি জাতিসংঘের দেওয়ানি আদালত। যা দেশগুলোর মধ্যে বিরোধের বিচার করে। এটি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) থেকে আলাদা, যা যুদ্ধাপরাধের জন্য ব্যক্তিদের বিচার করে থাকে।
ইংরেজি নববর্ষে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একাধিক ভিডিওতে দেখা যায়, রাত ১২টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে ইসরাইলের আকাশে উড়ে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে ক্ষেপণাস্ত্র। এসময় আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহার করে ১০টি ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করা হয়েছে বলে দাবি করেছে ইসরাইল। এসময় নববর্ষের অনুষ্ঠান পালন বাদ দিয়ে ভূগর্ভস্থ আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যেতে বাধ্য হয় বহু ইসরাইলি। ইসরাইলি গণমাধ্যমগুলো বলছে, এদিন গাজা থেকে তেল আবিবে অন্তত ২০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছে। ইসরাইলি সেনাবাহিনী লিখেছে, ইসরাইলে রকেট হামলার মধ্য দিয়ে ২০২৪ সাল শুরু করেছে হামাস। বিপরীতে ইসরাইলের পক্ষ থেকে বুরেজি শরণার্থী শিবিরে চালানো বিমান হামলায় কমপক্ষে ১৫ জনের মৃত্যুর তথ্য দিয়েছে আলজাজিরা। আর দেইর আল বালাহতে ইসরাইলি হামলায় কমপক্ষে ৫ জনের মৃত্যুর তথ্য দিয়েছে মিডল ইস্ট আই।
অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা থেকে যুদ্ধরত পাঁচটি ব্রিগেড প্রত্যাহার করে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসরাইল। একটি ব্রিগেডে সাধারণত তিন থেকে পাঁচ হাজার সেনা থাকে। সে হিসেবে গাজা থেকে ১৫ থেকে ২৫ হাজার সেনা প্রত্যাহার করে নিচ্ছে তেল আবিব। এর আগে গতমাসে ইসরাইল গাজা থেকে তাদের সবচেয়ে প্রশিক্ষিত ও দুর্ধর্ষ গোলানি ব্রিগেড প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়েছিল। ফিলিস্তিনি বার্তা সংস্থা প্যালেস্টাইন ক্রনিক দাবি করেছে, এই যুদ্ধে ইসরাইলের পরাজয়ের লক্ষণগুলো স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। গাজায় প্রায় তিন মাস ধরে আগ্রাসন চালানোর পরও ইসরাইলের অর্জন শূন্য। ইসরাইলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। হতাহত হয়েছে বহু সেনা। ধকল সামলাতেই এ সিদ্ধান্ত ইসরাইলের।
ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি ও ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে ৩৩ সন্দেহভাজনকে আটক করেছে তুরস্ক। আরও ১৩ সন্দেহভাজনকে খুঁজছে কর্তৃপক্ষ। আটকদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগে বলা হয়েছে, তুরস্কে বসবাসকারী বিদেশিদের ওপর হামলা এবং তাদের অপহরণের পরিকল্পনা ছিলো মোসাদের।
গাজায় সামরিক আগ্রাসন বন্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত ইসরাইলি সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা বলে মন্তব্য করেছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমিরাবদুল্লাহিয়ান। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, গাজায় অবিলম্বে একটি নিঃশর্ত মানবিক যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়া উচিত এবং অবরুদ্ধ অঞ্চলে মানবিক সাহায্য পাঠানো উচিত। তিনি আরো বলেন, গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলি বোমাবর্ষণ ও গণহত্যা স্পষ্টভাবে মানবিক ও আন্তর্জাতিক সমস্ত আইন লঙ্ঘন করেছে।
আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মতে গণতন্ত্র এবং প্রতিনিধিত্বশীল সরকার মুসলিম বিশ্বে খুবই কম এবং এ ধরনের দেশগুলোর সরকারকে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য প্রভাবশালী পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর নির্ভর করতে হয় বলে পশ্চিমাদের দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে যাওয়ার সুযোগ তাদের নেই। ফিলিস্তিনিদের স্বতন্ত্র-স্বাধীন রাষ্ট্রের পক্ষে প্রায় সকল মুসলিম রাষ্ট্রই বলিষ্ঠ অবস্থান নিয়েছে একেবারে শুরু থেকেই। এর কারণ যতটা না ধর্মীয় বা আন্তর্জাতিক, তার চেয়ে অনেক বেশি দেশের জনমত এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। মুসলিম দেশগুলো তাদের অভ্যন্তরীণ জটিল রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং পাশ্চাত্য নির্ভরতা বেড়ে যাওয়ার কারণেই ফিলিস্তিনের পক্ষে শক্তভাবে দাঁড়াতে পারছে না। “বেশিরভাগ দেশেই দুটি প্রবণতা—জনগণ ফিলিস্তিনের পক্ষে বেশি কিন্তু সরকার গুলোর কথায় জোর কম। তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ব্যবস্থার জটিলতার কারণেই তারা শক্তিশালী অবস্থান নিতে পারে না,”
ইসরায়েলের প্যারাট্রুপারদের একটি অভিজ্ঞ দলের ডেপুটি কমান্ডার দাভিদি বেন জায়ন বলেছেন “তারা (হামাস) ছিল খুব আগ্রাসী, পশুর মতো,”। তিনি আরো বলেন যে “হামাস বন্দুকধারীরা শিশুসহ পরিবারের সদস্যদের হত্যা করেছে। তারা সবাইকে খুন করেছে, যাদের কোন অস্ত্র ছিলো না, কিছুই ছিলো না। একেবারেই সাধারণ নাগরিক যারা সকালের নাশতা করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন”। ইসরাইলি সেনা কর্মকর্তা যদি এই ধরনের মন্তব্য করতে পারে, তাহলে তাদের সম্পর্কে কি মন্তব্য সঠিক ও মানানসই হতে পারে, যারা তিন মাসের ও কম সময়ে প্রায় নয় হাজার শুধুমাত্র শিশু হত্যা করেছে?
Leave a Reply