বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল ও বর্তমান সরকারের বিরোধী দল বিএনপি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত ‘অসহযোগ আন্দোলনের’ ডাক দিয়েছে। সাতই জানুয়ারির ভোট বর্জন করা, কর ও ইউটিলিটি বিল না দেয়ার জন্য প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে সর্বস্তরের জনগণের প্রতি আহবান জানিয়েছে। দলের মুখপাত্র ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে উদ্ধৃত করে বুধবার এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এই ঘোষণা দিয়েছেন।
রুহুল কবির রিজভী ভারপ্রাপ্ত সভাপতির বরাতে বলেছেন “অবৈধ সরকারকে অসহযোগিতার বিকল্প নেই। সাতই জানুয়ারির ডামি নির্বাচন বর্জন করুন। আপনারা ভোট কেন্দ্র যাবেন না, এটা আপনার অধিকার। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকুন,”। একই সাথে সরকার কে ট্যাক্স, খাজনা ও ইউটিলিটি বিল দেয়া স্থগিত রাখার আহবান জানিয়েছে বিএনপি। সেই সঙ্গে ব্যাংকে টাকা রাখা নিরাপদ কি না তা ভাবা এবং আদালতে মামলায় হাজিরা দেয়া থেকে বিরত থাকার জন্য বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের প্রতি আহবান জানিয়েছে তারা।
বিএনপি ও সমমনা দলগুলো মূলত গত ২৮শে অক্টোবর ঢাকায় তাদের মহাসমাবেশ পণ্ড করে দেয়ার পর থেকেই নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবিতে ধারাবাহিক হরতাল অবরোধের কর্মসূচি পালন করে আসছে। তবে দলটি বুধবার যখন অসহযোগ আন্দোলন ও ভোট বর্জনের ডাক দিলো তখন প্রায় একই সময়ে বাংলাদেশের সিলেট থেকে নির্বাচনী প্রচারাভিযান শুরু করেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলো নির্বাচন বর্জন করলেও আওয়ামী লীগ তাদের মিত্র দলগুলো নিয়ে এ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। যা স্পষ্টতই সংঘাতময় পরিস্থিতির ইঙ্গিতবাহী।
বিশেষজ্ঞররা মনে করছেন অসহযোগিতার আহবান জানানোর মধ্য দিয়ে দলটি অহিংস আন্দোলনেই থাকলো, তবে দেখার বিষয় হবে যে মানুষ- এমনকি বিএনপি নেতাকর্মীরাই এটা কতটা পালন করে। আদালতে হাজিরা না দেয়া কিংবা বিল, খাজনা, ট্যাক্স না দেয়ার আহবান বিএনপি কতটা বাস্তবায়ন করতে পারে দেখা যাক। তবে মনে রাখতে হবে যে একাত্তরে অসহযোগ আন্দোলন হয়েছিলো জাতীয় ঐক্যের কারণে। এখন জাতি বিভক্ত। এ পরিস্থিতিতে বিএনপি কী করতে পারে সেটাও হবে দেখার বিষয়।
চলমান আন্দোলন সম্পর্কে বিএনপির বক্তব্য প্রথমে উঠে আসে লন্ডনে থাকা দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ভিডিও বার্তায়। এরপর সেই ভিডিও বার্তাকে উদ্ধৃত করে ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলন করেন দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, আগামী সাতই জানুয়ারি আরো একটি একতরফা ও পাতানো ডামি নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সীলমোহর নেয়ার পরিকল্পনা করেছে। রিজভী আরো উল্লেখ করেন “প্রতিটি নাগরিকের অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে সরকারকে সব ধরনের অসহযোগিতার কোন বিকল্প নেই। প্রশাসনের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও জনগণের প্রতি আহবান জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান,”।
“আপনারা আগামী সাতই জানুয়ারির ডামি নির্বাচন বর্জন করুন। কেউ ভোট কেন্দ্রে যাবেন না, এটি আপনার গণতান্ত্রিক অধিকার। নির্বাচন কমিশন কাদেরকে জয়ী করবে, গণভবনে সেই তালিকা তৈরি হয়েছে। সুতরাং সাতই জানুয়ারির ডামি নির্বাচনের ভোট গ্রহণে কর্মকর্তা কর্মচারীরা দায়িত্ব পালনে বিরত থাকুন। ব্যাংকগুলো অবৈধ সরকারের লুটপাটের মাধ্যম। সুতরাং ব্যাংকে টাকা জমা রাখা নিরাপদ কি না ভাবুন। মিথ্যা ও গায়েবী মামলায় অভিযুক্ত নেতাকর্মীরা মামলায় হাজিরা দেয়া থেকে বিরত থাকুন। আপনাদের সুবিচার করার আদালতের স্বাধীনতা সরকার কেড়ে নিয়েছে”। ভারপ্রাপ্ত সভাপতিকে উদ্ধৃত করে বলেন
জনাব রিজভী।
অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়ে প্রশাসনের কর্মকর্তা কর্মচারীসহ সর্বস্তরের জনগণের প্রতি বিএনপি র ভারপ্রাপ্ত সভাপতি কিছু আহবান জানিয়েছেন।
“চলমান আন্দোলন চূড়ান্ত সফলতায় পৌঁছুতে দলীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে দল-মত-ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে মানুষকে বর্তমান অবৈধ সরকারকে অসহযোগিতা শুরু করুন। অপরকে অসহযোগিতা করতে উদ্বুদ্ধ করুন।”
“এই আন্দোলনে বিজয় লাভ করেই ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে রেখে দেশে একটি অবাধ সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে,” সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন রুহুল কবির রিজভী।
এদেশে অসহযোগ আন্দোলন হয়েছিলো একাত্তর সালে। সেটা হয়েছিলো জাতীয় ঐক্যের কারণে। কিন্তু বর্তমানের বাংলাদেশে ঐক্য নেই জাতি পুরোপুরি বিভক্ত। এছাড়া বিএনপির নেতাকর্মী ও সমর্থকরাই অসহযোগের প্রস্তাবে কীভাবে সাড়া দেয় সেটি ও হবে এখন দেখার বিষয়।
বিএনপি ও তাদের সমমনা দলের নেতারা আগেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে নির্বাচনের প্রচারণা শুরুর দিন থেকেই আরও শক্ত কর্মসূচিতে যাবেন তারা এবং এর মূল উদ্দেশ্য হবে সাতই জানুয়ারির ভোট বর্জন করা। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়ার বাইরে থাকা বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর নেতারা গত কয়েকদিন ধরে নির্বাচন প্রতিরোধের কথাও বিভিন্ন ভাবে বলে আসছিলেন। শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধের কথা না বললেও ‘প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সর্বস্তরের মানুষের’ প্রতি ভোট বর্জনের আহবান জানালো দলটি।
ইতোমধ্যে বিএনপির ‘শতাধিক’ হেভিওয়েট নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। বিএনপির নেতা-কর্মীদের ব্যাপকভাবে কারাদণ্ড দেবার খবরটি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়ছে। বিএনপির অভিযোগ, ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ হয়ে ‘পূর্ব-পরিকল্পিত’ভাবে তাদের নেতা-কর্মীদের সাজা দেয়া হচ্ছে। বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল অভিযোগ করেন, বিএনপির নেতারা যাতে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে না পারে সেজন্যই এই সাজা দেয়া হয়েছে।
২৮শে অক্টোবর ঢাকায় সমাবেশ ও চাপিয়ে দেয়া সংঘাতের পর থেকে ব্যাপক গ্রেফতার ও মামলায় জর্জরিত এখন বিএনপি। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বিএনপি নেতা-কর্মীদের আটক করেছে পুলিশ। যথাসাধ্য চেষ্টা চালানো হয়েছে বিএনপিকে ভাঙার, যদিও সফলতার পরিমাণ যৎসামান্যই। ঢাকায় পুলিশ হত্যা ও নাশকতা মামলা এবং পরবর্তীকালে অবরোধ কর্মসূচীকে কেন্দ্র করে মামলা হওয়ায় বিএনপির নেতাকর্মীরা বাড়িঘর ছেড়ে আত্মগোপনে রয়েছেন বলেও জানা যাচ্ছে।
আসলেই কি এই অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে গনতন্ত্র বা মৌলিক অধিকার বা ভোটাধিকার আগের চেয়ে ভালো জায়গায় যাবে বা উন্নত হবে? ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে এ প্রশ্নের জবাবের অপেক্ষায়।
Leave a Reply